Prothom Alo সম্পাদকীয়
মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ঠেকান
কৃষকের লাভ সবচেয়ে কম
চিত্রপরিচালকেরা
কৃষি নিয়ে একটা ছবি তৈরি করতে পারেন। গল্পটি হবে এমন: একদিকে কৃষিবিজ্ঞানী
ও সরকারি কর্মকর্তারা কৃষির সম্ভাবনা নিয়ে অপূর্ব স্বপ্ন দেখাচ্ছেন,
অন্যদিকে কৃষক ফসলের উৎপাদন খরচ তুলতে না পেরে চাষবাস ছেড়ে দিচ্ছেন। মঞ্চে
যাঁকে আদর করে ‘চাষিভাই’ ডাকা হচ্ছে, মাঠে নামলে তিনিই হয়ে যাচ্ছেন ‘চাষার
বাচ্চা চাষা’। ফসল ফলিয়ে বিশ্বায়িত বাজারে জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্নপূরণ
দূরে থাক, পেটের পীড়ন সামলে টিকে থাকাই চাষির জন্য দুরূহ হয়ে উঠছে।
এমন গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র বানান বা না বানান, গল্পটা আছে। সেটা ঘুরে ঘুরে চলতেই থাকবে।
কৃষক ফসল ফলাচ্ছেন। কিন্তু দাম পাচ্ছেন না। লাভের গুড় খেয়ে
ফেলছে মধ্যস্বত্বভোগী পিঁপড়ারা। কৃষকের ফলানো কাঁঠাল তাঁরই মাথায় ভেঙে
খাচ্ছে ফড়িয়া, আড়তদার, খুচরো বিক্রেতারা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য
অনুযায়ী, কৃষিপণ্য কৃষকের কাছ থেকে ভোক্তার কাছে যেতে অন্তত তিন দফা হাতবদল
হয়। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা
কৃষকের চেয়ে অনেক বেশি লাভ করেন। চাষির পণ্য বিক্রি করে কয়েক গুণ বেশি লাভ
করেন এই মধ্যস্বত্বভোগীরা।
সবজিচাষিরা সবচেয়ে বেশি ঠকছেন। ২০১৭-১৮ সালে এক কেজি টমেটোতে
কৃষকের লাভ ছিল ২ টাকা ১০ পয়সা, স্থানীয় ব্যবসায়ী লাভ করছেন ৩ টাকা ৫ পয়সা,
পাইকারের লাভ ছিল ৬ টাকা ৬০ পয়সা এবং খুচরো বিক্রেতার লাভ ছিল ৭ টাকা ২৫
পয়সা। প্রায় সব সবজির ক্ষেত্রেই এই চিত্র দেখা যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই
গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এখনো
গ্রামাঞ্চলের ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ–পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
তাই সরকারকে কৃষি ও কৃষক নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলতেই হচ্ছে। কিন্তু সেসব
কথা কার্যকর করার জন্য যে প্রচেষ্টা ও বিনিয়োগ দরকার, তা কার্যত হচ্ছে না।
কৃষক তাঁর ফসলের ন্যায্যমূল্য কেন পাবেন না, তা নিয়ে সরকারি মহলে তেমন কোনো
কথা শোনা যায় না। এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক দিকটিতে কৃষকের কণ্ঠ অনেক
কমজোরি। দেশের কৃষিনীতি তৈরি হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে।
সবজিচাষিদের মতো লোকের কথা কেউ তেমন চিন্তা করেন না।
সরকারি নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা চাষির অতিরিক্ত লোকসানের
বড় কারণ। ফসল ওঠার আগে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তাঁর মনে এমন শঙ্কা তৈরি করা
হয়, যাতে তিনি যা পাওয়া যায় সেই দামেই দ্রুত ফসল বিক্রি করে দেন। এভাবে
কৃষি খাতের অগ্রগতি টেকসই হবে না। কৃষকের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার আগেই বড়
ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
পরীক্ষার্থীদের ওপর এই মানসিক চাপ কেন?
এসএসসি পরীক্ষায় অব্যবস্থাপনা
২ ফেব্রুয়ারি
থেকে দেশজুড়ে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা চলছে। এ পর্যন্ত
একাধিক বিষয়ের পরীক্ষায় যে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও ভুলত্রুটির ঘটনা ঘটেছে,
তা অগ্রহণযোগ্য ও অমার্জনীয়। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেনি, এটি ভালো কথা। কিন্তু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত
ঘটনা পরীক্ষার্থীদের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে।
প্রথম দিনে বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষায় চট্টগ্রাম, জামালপুর,
নওগাঁ, শেরপুর, সাতক্ষীরা, মুন্সিগঞ্জ, গাইবান্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া,
বাগেরহাট ও মাদারীপুরের মোট ১৮টি কেন্দ্রে নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের ভুল
প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। এসব প্রশ্নপত্র ছিল পুরোনো পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে
অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য। এ ছাড়া চট্টগ্রামের পটিয়ার একটি কেন্দ্রের
জন্য থানা ট্রেজারি থেকে প্রশ্নপত্র যাছাই করে নেওয়ার সময় ভুল করে ১০১
কোডের (বাংলা প্রথম পত্র) বদলে ১২৬ কোডের (উচ্চতর গণিত) কয়েক প্যাকেট
এমসিকিউ প্রশ্নপত্র চলে যায়।
এসএসসি পরীক্ষার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গাফিলতির
এখানেই শেষ নয়। ৯ ফেব্রুয়ারি যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে তথ্য ও
যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের একটি অংশে পরদিনের
ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ের প্রশ্নপত্র ছাপা হয়েছে। বিষয়টি বোর্ড কর্তৃপক্ষের
নজরে এলে যশোর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ আইসিটি বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল করে।
আবার একটি বিষয়ের প্রশ্নপত্রের ছাপা ছিল ত্রুটিপূর্ণ, বাঁ দিকে কাটা, যা
শিক্ষার্থীদের পক্ষে উদ্ধার করা কঠিন ছিল। সব মিলে সবাই না হলেও অনেক
এসএসসি পরীক্ষার্থীকে বিপদ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। পরীক্ষার তারিখ
একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে।
প্রথম দিনের পরীক্ষার ত্রুটি ধরা পড়ার পর শিক্ষামন্ত্রী দীপু
মনি বলেছিলেন, সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র অন্যভাবে দেখা হবে, যাতে
শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কিন্তু একের পর এক প্রশ্নপত্র বিতরণে
অনিয়ম ও ত্রুটির কারণে পরীক্ষার্থীদের ওপর যে প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি
হয়েছে, তার ক্ষতি অপূরণীয়। ভুল প্রশ্নপত্রের কারণে আইসিটি পরীক্ষার
পাশাপাশি ১৬, ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে হয়েছে। এর
ফলে পরীক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
এসএসসির
প্রশ্নপত্র মুদ্রণ বা বিতরণে কীভাবে অনিয়ম হলো, কারা এ জন্য দায়ী, সেটি
খুঁজে বের করা জরুরি। আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব–কমিটি ও ঢাকা শিক্ষা
বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক বলেছেন, যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, তা
মুদ্রণত্রুটি। মুদ্রণত্রুটি বোর্ডের হাতে নয়। মুদ্রণত্রুটি বোর্ডের হাতে নয়
বলে তাঁরা পুরোপুরি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। প্রশ্নপত্র ছাপার দায়িত্ব
বিজি প্রেসের হলেও বিতরণের কাজটি করে থাকেন পরীক্ষা গ্রহণকারী ও কেন্দ্রের
সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাই। প্রশ্নপত্র মুদ্রণ কিংবা বিতরণ—যেকোনো পর্যায়ে
সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে পরীক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সে কথাও তাঁদের
অজানা নয়।
অনেক সময় দেখা যায়, এসব অনিয়ম, ত্রুটি ও দুর্নীতির সঙ্গে
যঁারা জড়িত, তাঁরা অনায়াসে পার পেয়ে যান। সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো
গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে পারলে অনিয়ম, ত্রুটির সঙ্গে
জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা কঠিন নয়।
মূলত জবাবদিহি না থাকা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই সব
পর্যায়ে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটছে। শিক্ষার হার বাড়লেও মানের অবনতি ঘটে
চলেছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ১০ বছরে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে। এবার
মানের দিকে নজর দিতে হবে। মানের দিকে নজর দিতে হলে প্রথমেই দায়িত্বে
অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায়
আনতে হবে।
লোক দেখানো তদন্ত নয়। একটি নিরপেক্ষ কমিটির দ্বারা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
সহাবস্থান ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করুন
ডাকসুর তফসিল
সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ
ছাড়া সব ছাত্রসংগঠনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচন
পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিরোধী
ছাত্রসংগঠনগুলোর কথা আমলে না নিয়ে পূর্বনির্ধারিত ১১ মার্চই ডাকসু নির্বাচন
অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তফসিল অনুযায়ী, ২০ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত ভোটার
তালিকা প্রকাশ, ১৯ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মনোনয়নপত্র বিতরণ এবং
চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা হবে ৩ মার্চ।
গত সোমবার তফসিল ঘোষণার পর এর পক্ষে ছাত্রলীগ ও বিপক্ষে
বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে। তবে আশার কথা, কোনো
ছাত্রসংগঠন এমন কথা বলেনি যে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। এটিকে ইতিবাচক
হিসেবে ধরে নিয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য
অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন জোট
ক্যাম্পাসে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে।
বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ছাত্রলীগের আশ্বাসকে স্বাগত জানিয়ে
বলেছে, এটি শুধু কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, এর বাস্তবায়ন হতে হবে।
বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর মতে, ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ছাত্রলীগ তাদের
গত ১০ বছরের ছাত্রস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডকে ধামাচাপা দিতে এ ধরনের লোক
দেখানো আশ্বাস দিচ্ছে। হলগুলোয় তাদের দখলদারি এখনো বজায় আছে। আছে গণরুম ও
গেস্টরুম সংস্কৃতিও।
ক্যাম্পাস বা হলে কোনো ছাত্রসংগঠনের দখলদারি বজায় রেখে
সুষ্ঠুভাবে ডাকসু বা হল সংসদের নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনের আগেই সেখানে
প্রতিদ্বন্দ্বী সব ছাত্রসংগঠনের সম–অধিকার ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
দলমত-নির্বিশেষে সবাই যাতে অবাধে নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারে, সেই
নিশ্চয়তা কর্তৃপক্ষকেই দিতে হবে। হলগুলোতে ছাত্রলীগ গণরুম ও গেস্টরুম
সংস্কৃতির নামে যে জবরদস্তি চালাচ্ছে, সেসবও বন্ধ করা জরুরি। নির্বাচনের
আগে ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ ও ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশই প্রত্যাশিত।
অভিযোগ আছে, অধিকাংশ হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষক
সরকার–সমর্থক নীল দলের সদস্য। এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বিরোধী
ছাত্রসংগঠনগুলোর সংশয় অমূলক নয়। শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন,
শিক্ষকেরা সাদা ও নীল দলে বিভক্ত থাকলেও হলগুলোর প্রশাসনিক দায়িত্বে শুধু
নীল দলের শিক্ষকেরা আছেন। প্রশাসন শুধু একটি ছাত্রসংগঠনের কথা শুনছে। এমনটি
কেন হবে? শিক্ষকদের কাছে সব ছাত্রসংগঠনেরই সমান গুরুত্ব পাওয়া উচিত, সবাই
তাঁদের শিক্ষার্থী। কারও প্রতি তাঁরা পক্ষপাত বা বৈষম্য দেখাতে পারেন না।
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে হবে, ২৮ বছর পর দেশের ‘দ্বিতীয়
পার্লামেন্ট’ হিসেবে পরিচিত ডাকসুর নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন যেন
কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থী তো বটেই, সারা
দেশের মানুষের আগ্রহ আছে। ১৯৭৩ সালের পুনরাবৃত্তি নয়, ডাকসু নির্বাচন
সুষ্ঠু ও সফল হোক, এটাই প্রত্যাশিত।যৌথ বিজ্ঞপ্তিতে তিস্তার অনুল্লেখ হতাশাব্যঞ্জক
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর
বাংলাদেশের
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে ভারতকে বেছে
নেওয়ার মধ্যে এ দুই দেশের সুসম্পর্কের প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলাদেশ–ভারত
জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের পঞ্চম বৈঠকে উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তবে আমাদের
দেশে প্রধান আগ্রহের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ও
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের গণহত্যার বিচার এবং শরণার্থী সংকট উত্তরণে
ভারতের অবস্থান। কিন্তু রোহিঙ্গা বিষয়ে ভারতীয় অবস্থান আংশিক জানা গেলেও
যৌথ বিজ্ঞপ্তিতে তিস্তা চুক্তির উল্লেখ না থাকা আমাদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সরকারের মেয়াদের
সূচনায় বাংলাদেশে প্রথম সফরকালে অবিলম্বে তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদ–নদীর
পানির ভাগাভাগির বিষয়ে অঙ্গীকার করেছিলেন। তার পরের বছরগুলোতে দুই দেশের
সম্পর্ক ক্রমে ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। ভারতের নেতারা ও শীর্ষস্থানীয়
সংবাদমাধ্যমগুলো এই খবরই দিয়ে আসছে যে নিরাপত্তাসহ এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় নেই, যেখানে বাংলাদেশ ভারতের প্রত্যাশা পূরণে কার্পণ্য করেছে। গত মে
মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা কোনো প্রতিদান চাই না। আমরা
ভারতকে যা দিয়েছি, সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে।’
সুসম্পর্ক ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই উভয় দেশ এগিয়ে যেতে পারে।
এ সম্পর্কের বিকাশ প্রচলিত দর–কষাকষির বাইরে থাকা উচিত। তিস্তা নদীর পানির
ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের জনগণের আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত একটি
অধিকার। এটা এ দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন–মরণ প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। অথচ
বিষয়টি ভারতের একটি রাজ্য সরকারের ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার’ ওপর ঝুলছে
বলে দাবি করা হয়ে থাকে। এটা তো অনুচিত, অনুদার প্রতিবেশী নীতির পীড়াদায়ক
প্রতিফলন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তিনি তাঁর ও
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়াদের মধ্যে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করবেন।
মেয়াদ শেষে শেখ হাসিনা পুনর্নির্বাচিত। ভারতে নির্বাচন অত্যাসন্ন। টানা
তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনকে ভারত প্রথম
স্বাগত জানিয়েছে। এই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ভারত সফরে গেলেন, তখন
বাংলাদেশের জনসাধারণের এমন প্রত্যাশা স্বাভাবিক ছিল যে তিনি একটা সুখবর বয়ে
আনবেন। নয়াদিল্লিতে প্রকাশিত যৌথ বিজ্ঞপ্তিতে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী,
‘প্রতিটি খাত—নিরাপত্তা থেকে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ
প্রবাহ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, নদীর পানি বণ্টন, পরিবহন কানেকটিভিটি,
সংস্কৃতি এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে’, অতীতের থেকে ঘনিষ্ঠতরভাবে
কাজ করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ঢাকায় ১০ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
তিস্তার ‘আশু সুরাহা’ চেয়েছেন আর ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘আশু সমাধানের’
আশ্বাস দিয়েছেন।
ভারতের
প্রচারিত যৌথ বিজ্ঞপ্তিতে প্রত্যেক ‘বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার নিরাপদ, দ্রুত ও
টেকসই প্রত্যাবাসনের’ আশ্বাস রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ভারত থেকে বিতাড়িত
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের বিষয়টি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের
কাছে তুলে ধরেছেন কি না, তার উল্লেখ নেই। রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে
অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচারেও বাংলাদেশ ভারতকে কিছু
বলেছে বা ভারত বিষয়টিকে কীভাবে দেখে, এ বিষয়েও বাংলাদেশের জনগণ জানতে চায়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর মেয়াদে তিস্তা
চুক্তি করার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, আমরা ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের
আগেই তা পূরণ করার আহ্বান জানাই। ভারত সরকার সে দেশ থেকে রোহিঙ্গা
উদ্বাস্তুদের কী নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশে ঠেলে দিল, আমরা তারও ব্যাখ্যা
আশা করি।
নাগরিক অধিকার খর্ব করে উন্নয়ন নয়
উন্নয়ন ও মানবাধিকার
গত রোববার পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় ও ঢাকায় জাতিসংঘ দপ্তর যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ ও মানবাধিকার’ শীর্ষক
যে সেমিনারের আয়োজন করেছে, নানা কারণেই তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই
সেমিনার এমন সময়ে আয়োজন করা হয়েছে, যখন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি
নিয়ে অনেক বিদেশি সংস্থা ও সংগঠন সমালোচনামুখর। এ সময়ে মানবাধিকার বিষয়ে
সরকারের অবস্থান পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। কেননা মানবাধিকারের বিষয়ে আমাদের
মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত যত ফারাকই থাকুক না কেন, এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা
কোনোভাবে অগ্রাহ্য করতে পারি না।
এই সেমিনারে মানবাধিকার নিয়ে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি
মিয়া সেপ্পোসহ অন্যান্য বক্তার সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল
মোমেনের বক্তব্যের পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। অন্য বক্তারা মতপ্রকাশ ও নাগরিক
অধিকারকে মানবাধিকারের পূর্বশর্ত হিসেবে অভিহিত করলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই প্রধান মাপকাঠি বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু মানবাধিকার
নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ও
বাংলাদেশের সংবিধানের বাইরে যেতে পারি না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের মানবাধিকারের যথেষ্ট উন্নতি
হয়েছে বলে দাবি করেছেন এবং এর পক্ষে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদাহরণ টেনেছেন।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি মানবাধিকারের একমাত্র মাপকাঠি হতো, তাহলে চীন বা
মালয়েশিয়ার মানবাধিকার নিয়ে এত কথা উঠত না। মানবাধিকারের সঙ্গে অবশ্যই
নাগরিকের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের বিষয়টি যুক্ত। আমাদের
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার
নিশ্চয়তাদান করা হইল’ ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।’ এই
অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার দেওয়ার
কথাও বলা আছে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এমন আইন করতে পারে না, যা এই
স্বাধীনতার পরিপন্থী।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি কেউ অস্বীকার করছে না। তবে
সেই উন্নয়নের সুবিধা সব নাগরিক পাচ্ছেন কি না, তা–ও ভেবে দেখার বিষয়।
একদিকে বাংলাদেশে দ্রুত ধনী হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে বিশ্বের
অধিক দরিদ্র মানুষ যে পাঁচটি দেশে বসবাস করছে, সেই তালিকায়ও আছে। অতএব,
উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে যেমন বৈষম্য দূর করতে হবে, তেমনি নাগরিক
স্বাধীনতার বিষয়টিও নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
সেমিনারে
নাগরিক অধিকারের অন্তরায় হিসেবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জাহালমের মতো
নিরপরাধ মানুষের জেল খাটা, ধর্ষণের আসামির ‘হারকিউলিস’ হওয়ার প্রবণতা এবং
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধার কথাও আলোচনায়
এসেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যানসহ অনেকেই এসব বিষয়ে
উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এড়িয়ে গেছেন। তিনি মানবাধিকার
সম্পর্কে অনেকের ধারণা ‘দুর্বল’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, সেটি নাগরিকের
মানবাধিকার উপেক্ষা করার শামিল। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোনোভাবে নাগরিক
স্বাধীনতার বিকল্প হতে পারে না।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে শুধু মানুষের আহার-বাসস্থানের
কথা নেই, ধর্ম, বর্ণ জাতি ও নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব নাগরিকের
গণতান্ত্রিক অধিকারের কথাও আছে। মানবাধিকার প্রশ্নে জাতিসংঘ প্রতিনিধি মিয়া
সেপ্পো নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতার ওপর জোর দিয়েছেন, যা পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বক্তব্যের সমার্থক নয়। জাতিসংঘ সনদের প্রতি আমাদের যে অঙ্গীকার আছে, সেটি
প্রতিপালনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ হতে পারে সত্যিকার মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন ও
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
সবাইকে মনে রাখতে হবে যে সেমিনারে, সভায় বক্তৃতা দিলেই
নাগরিক বা মানবাধিকার নিশ্চিত হয় না। নাগরিক অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে, সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ
করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের নামের আগে ‘স্বাধীন’ শব্দবন্ধও পরিস্থিতির উন্নয়ন
ঘটাতে পারবে না, যদি না সংশ্লিষ্টদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়।
কারণ চিহ্নিত করে প্রতিকার করুন
মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:৪০
আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:৪০
আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:৪০
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ‘বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য-২০১৮’-এর প্রতিবেদনে
একটি উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে মাধ্যমিকে ছেলেদের
ঝরে পড়ার হার আড়াই শতাংশ বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন মাধ্যমিকে
ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ৩৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ; যা আগের বছর ছিল ৩৩ দশমিক ৪৩
শতাংশ। আর ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার ১ শতাংশের কিছু বেশি কমলেও এখনো সেই হার
৪০ দশমিক ১৯ শতাংশ। ব্যানবেইসের এ তথ্য দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার
দুর্বলতাই তুলে ধরে।
আমরা প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তির লক্ষ্য
অর্জন করতে পারলেও দেখা যাচ্ছে যে এই শিশুদের একটা বড় অংশ মাধ্যমিক পর্যায়
পেরোতে পারছে না। এসএসসি বা সমমানের শিক্ষা অর্জন করার আগেই তাদের
শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। কেননা, এ দেশে এখন
এসএসসি ও সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতায় ভালো কোনো চাকরি মেলে না। উপরন্তু, এ
পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আগেই যারা ঝরে পড়ছে, তাদের কোনো ডিগ্রিই নেওয়া হচ্ছে
না। এরা তাদের অর্জিত শিক্ষা অচিরেই ভুলে যায় এবং অদক্ষ জনবলের খাতায় যুক্ত
হয়।
মাধ্যমিকে ঝরে পড়া রোধ করতে হলে প্রথমে সমস্যার কারণগুলো
চিহ্নিত করতে হবে। জানতে হবে, এ পর্যায়ে এসে কী কী কারণে শিক্ষার্থীরা ঝরে
পড়ছে। সমাজের কোন শ্রেণির সন্তানদের মধ্যে ঝরে পড়ার হার বেশি। ধনী বা সচ্ছল
পরিবারের তুলনায় দরিদ্র বা অসচ্ছল পরিবারে, শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেশি কি না; অঞ্চলবিশেষে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক
কারণও রয়েছে কি না—এসব খতিয়ে দেখতে হবে। কারণগুলো চিহ্নিত করতে
ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা প্রয়োজন। এই দায়িত্ব নেওয়া উচিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।
সমস্যার কারণগুলো জানলে তাদের পক্ষে এর সমাধানও সহজ হবে। বেসরকারি
সংস্থাগুলোও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এই কাজ করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেছেন, এই বয়সী ছেলেরা এলাকাভিত্তিক
বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে যায়। তখন বিদ্যালয়ে না যেতে যেতে ঝরে পড়ার দিকে
যায়। আর মেয়েদের ঝরে পড়ার বড় কারণ হলো দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা,
বাল্যবিবাহ ইত্যাদি। অনেকে আবার বলছেন, শিক্ষকদের রূঢ় আচরণ, অতিরিক্ত
পরীক্ষার চাপ, প্রাথমিক স্তর থেকে ওপরের দিকে শিক্ষার ব্যয় ক্রমেই বেড়ে
যাওয়া ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে। এটাও
গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার ও শিক্ষা
খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষার বিস্তারে
দরিদ্রবান্ধব যেসব কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
পাশাপাশি শিক্ষা যাতে ভীতিকর না হয়ে আগ্রহের বিষয় হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে
হবে।
0 comments:
Post a Comment