Ittefaq সম্পাদকীয়




 

 

 

ইহা তো দুধ নহে, বিষ

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’—ভারতচন্দ্র রায়গুণাকার এই বর চাহিয়াছিলেন। সন্তানদের জন্য দুধে-ভাতের জোগান রাখাটা খুব সহজ ছিল না মধ্যযুগে। এখন তুলনামূলকভাবে সহজ। আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাইতেছে দিন দিন, দারিদ্র্যের হার হ্রাস পাইতেছে ক্রমশ। কিন্তু ভেজালের বিষে আমাদের কষ্টার্জিত অর্জনগুলি যেন ষোলো আনাই মিছে হইয়া যাইতেছে। সম্প্রতি প্রক্রিয়াকরণ ছাড়া গাভীর দুধে সহনীয় মাত্রার চাইতে অধিক পরিমাণে কীটনাশক ও নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গিয়াছে। শনাক্ত করা হইয়াছে বিভিন্ন অণুজীবও। একই সঙ্গে প্যাকেটজাত গাভীর দুধেও মিলিয়াছে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসা। দই ও দুগ্ধজাত পণ্যেও শনাক্ত হইয়াছে সিসা। আর এই সকল তথ্য উঠিয়া আসিয়াছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) গবেষণায়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরিতে এই গবেষণা জরিপ চালানো হয়। গবেষকরা জানাইয়াছেন যে, গো-খাদ্যের ৩০টি নমুনার মধ্যে চারটিতে টোটাল আলফাটক্সিন, ২২টিতে টেট্রাসাইক্লিন, ২৮টিতে এনরোফ্লক্সাসিন ও ৩০টিতে সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গিয়াছে। গরুর দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯ শতাংশ দুধে পাওয়া যায় স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে বেশি কীটনাশক, ১৩ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিন ও প্রায় ১৫ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চাইতে বেশি মাত্রায় সিসা। একটি নমুনায় মিলিয়াছে সিপ্রোফ্লক্সাসিন। আর ৯৬ শতাংশ দুধে পাওয়া গিয়াছে বিভিন্ন অণুজীব। প্যাকেটজাত দুধের ৩১টি নমুনার মধ্যে ৩০ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চাইতে বেশি হারে রহিয়াছে টেট্রাসাইক্লিন। একই সঙ্গে প্যাকেটজাত দুধের ৬৬-৮০ শতাংশ নমুনায় পাওয়া গিয়াছে বিভিন্ন অণুজীব। দইয়ের ৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করিয়া ৫১ শতাংশ নমুনায় মিলিয়াছে বিভিন্ন অণুজীব। খাদ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আলফাটক্সিন, সিসা ও কীটনাশকযুক্ত তরল খাবার খাইলে মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়া যায়। অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক খাবারের সঙ্গে শরীরে ঢুকিয়া পড়িলে পরিপাক ক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি হয়, ইহাতে শরীরের মধ্যে বিদ্যমান উপকারী জীবাণুর সংখ্যাও কমিয়া যায়, তাহাতে হজমে সমস্যা হয়।
বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, গরুর দুধ ও প্যাকেটজাত দুধে সিসা ও ক্রোমিয়াম মিলিবার সংবাদটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এইসকল দ্রব্য মানবদেহে প্রবেশের চূড়ান্ত পরিণতি ক্যান্সার। কিডনির কাজ হইল শরীরের নানা দ্রব্য ছাঁকিয়া ফেলিয়া দেওয়া, কিন্তু কিডনি এইসকল দ্রব্য ছাঁকিতে পারে না। ফলে, এইগুলি দেহে জমা হইতে থাকে, যাহার পরিণতি হয় মারাত্মক। মনে রাখিতে হইবে, আগুনের আঁচে দুধ ফুটাইলে কিছু কিছু অণুজীব নষ্ট হইতে পারে, কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক বা সিসা নষ্ট হয় না। দুধসহ খাদ্যে ভেজাল মিশানো মারাত্মক দুর্নীতি বলিয়া গত সোমবার মন্তব্য করিয়াছেন হাইকোর্ট। এই দুর্নীতির ব্যাপারে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা লইতে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে নির্দেশও দিয়াছেন আদালত। আমরা আশা করিব, জনস্বার্থে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসরণ করিয়া অনতিবিলম্বে ইহার শিকড় খুঁজিয়া বাহির করা হইবে। পাশাপাশি, অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রেও ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) হালনাগাদ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা জরুরি।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভবিষ্যত্



আগামী মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের (ইউপি) নির্বাচনের পরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) ভবিষ্যত্ কেমন হইবে তাহা লইয়া ইউরোপপন্থিদের মধ্যে আশঙ্কার সৃষ্টি হইয়াছে। দ্য ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনস (ইসিএফআর) নামক প্রভাবশালী একটি প্রতিষ্ঠানের সদ্য-প্রকাশিত একটি গবেষণায় এইবারের ইউপি নির্বাচনে ইউরোপপন্থি দলগুলির খারাপ ফলের আভাস দেওয়া হইয়াছে। ইহার বিপরীতে, সমন্বিত-ইউরোপের ধারণার বিরোধিতাকারী উগ্র জাতীয়বাদী দলগুলি এইবার ইউপি’র এক-তৃতীয়াংশের মতো আসন দখল করিয়া ফেলিতে পারে বলিয়া জানানো হইয়াছে। ইসিএফআর-এর ধারণা সত্য প্রমাণিত হইলে, বিশেষ করিয়া, মুক্ত-বাণিজ্য ও অভিবাসন নীতিমালার ক্ষেত্রে গত কয়েক দশক ধরিয়া গড়িয়া ওঠা আন্তঃইউরোপীয় ঐকমত্য নষ্ট হইবার উপক্রম হইবে। এই শক্তিটি ইউপি’র ভিতর হইতেই সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়া ক্রমশ ইইউকে নিস্তেজ করিয়া ফেলিতে চাহিবে।
একদা আন্তঃইউরোপীয় সমৃদ্ধি ও ঐক্যকে লক্ষ্য হিসাবে সামনে রাখিয়া ইইউ’র পথচলা শুরু হইয়াছিল। সদস্য দেশগুলির সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখিয়াই মহাদেশীয় সংহতির পথে অনেকখানি অগ্রসর হইয়াছিল ইইউ। সদস্য দেশগুলির মধ্যে একক মুদ্রা, একক বাজার, অবাধ বসতির সুযোগসহ অনেকগুলি অগ্রগতি অনেকের মনে ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্নও জাগাইয়া তুলিয়াছিল। সেই স্বপ্ন বর্তমানে ফিকে হইয়া গিয়াছে বলিলেও কম বলা হয়। বরং পরিস্থিতি বর্তমানে এমন এক জায়গাতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যে ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গটি এক্ষণে একটি দিবাস্বপ্নে পরিণত হইয়াছে বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধপরবর্তীকালে মহাদেশীয় বন্ধনের প্রতিভূ এই সংগঠনটি কেন ঝুঁকির মধ্যে পড়িয়া যাইতেছে? বস্তুত ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলির মধ্যে প্রভাবশালী দলগুলির ভিতর-বাহিরের দ্বন্দ্ব ইউরোপ-বিরোধীদের কাজ অনেকটাই সহজ করিয়া দিয়াছে। এইক্ষেত্রে জার্মানি ও ব্রিটেনের মতো দেশের কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করিয়া ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যে কমপক্ষে তিনটি ভিন্ন ধারা বিরাজ করিতেছে। পক্ষান্তরে, ব্রেক্সিট লইয়া করণীয় প্রসঙ্গে প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরোমি করবিনের সহিত দলীয় এমপিদের বৃহত্ অংশের মতভেদ নিয়মিতই প্রকাশ্য হইতেছে। আবার কনজারভেটিভ ও লেবার পাটির্র মধ্যে ব্রেক্সিট লইয়া বিভেদ তুঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের উগ্র-জাতীয়তাবাদী ব্রেক্সিটপন্থিরা কিংবা ইউকে ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টির মধ্যে উগ্র-ব্রেক্সিটপন্থি দল ক্রমশ রাজনীতিতে আসন গাড়িয়াছে। এমনকি ব্রেক্সিট পার্টির মতো নবগঠিত দলও এই মুহূর্তে শক্তি সঞ্চয় করিয়া চলিয়াছে। জার্মানিতে ক্ষমতায় আসীন শরিক দুই দল অর্থাত্ ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রাটিক ইউনিয়ন ও ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়নের মধ্যে অভিবাসী-শরণার্থী নীতি বিষয়ে মতানৈক্যের সুযোগে অল্টারনেটিভ ফর ডয়েসল্যান্ডের মতো ইইউ-বিরোধী কড়া জাতীয়তাবাদী দল আসন গাড়িয়া বসিয়াছে। ইতালি কিংবা হাঙ্গেরির মতো দেশে ইইউ-বিরোধী নেতারাই ক্ষমতায় আসীন হইয়াছেন। দুর্বল ইইউ কিংবা ইইউ-এর অবসানের ঝুঁকি সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকিবার কারণেও ইউরোপ-বিরোধীরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করিতে পারিতেছে। এমতাবস্থায় আগামী মে মাসের ইউপি নির্বাচন গোটা মহাদেশ তথা বিশ্বের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিবে বলিয়া মনে হইতেছে।

0 comments:

Copyright © 2018 Info Bank