ব্লু হোয়েল - একটি মৃত্যু কথন


Blue Whale
নীল তিমি তো সকলেই চেনেন। তারা শত শত বছর বেঁচে থাকে। কিন্তু তাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। জীবনের একটি পর্যায়ে নীল তিমি নিজেই চলে আসে সমুদ্র তীরে। ২০০৮ সালে ৫৫ টি নীল তিমি একযোগে সমুদ্র সৈকতে চলে আসে। কিন্তু উদ্ধারকারীরা তাদেরকে সাগরে ফেরত পাঠালেও, তারা তীরের দিকে চলে আসে! আত্মহত্যাই যেন তাদের উদ্দেশ্য! ধীরে ধীরে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার এই গেইমটির তাই নাম দেয়া হয়েছে নীল তিমি বা Blue Whale।
.
রাশিয়ান আন্ডারওয়ার্ল্ড এর যুবক ফিলিপ বুদেকিন ছিল মনোবিজ্ঞানের ছাত্র। ব্লু হোয়েল গেইম তারই এক উদ্ভট আবিষ্কার। তাকে গ্রেপ্তার করে তার জবানবন্দী শুনে অবাক হয়ে যায় পুশিল ডিপার্টমেন্ট! তার দাবী, "সে সমাজ পরিষ্কার করতেই এই গেইম বানিয়েছে। মানসিক বিষাদগ্রস্ত মানুষের সমাজে কোনো প্রয়োজন নেই। আর এ গেইম শুধু মানসিক বিষণ্ণতায় থাকা লোকের পক্ষেই খেলা সম্ভব।" এই মাস্টারমাইন্ডের বর্তমান ঠিকানা জেল খানা হলেও তার দলের লোকেরা এই গেইম নিয়ে দিন দিন হয়ে উঠছে বিপদজনক।
.
আসুন দেখি কি আছে এই গেইমে, যার জন্য নাকি মানুষ জীবন দিয়ে দেয়!

এই এমন একটি গেইম যেখানে আপনাকে চেলেঞ্জ দেওয়া হবে এবং তা নিতে বাধ্য করা হবে। ৫০ টি লেভেল সম্পন্ন এই গেমটির প্রথম ১০ লেভেল একেবারেই সোজা এবং যে কেওই এটি পুরণ করতে পারবে। যেমন, বলা হবে সকাল ৪:২০ এ উঠতে হবে, একটি হরর মুভি দেখতে হবে, আপনার প্রিয় খাবার খেতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু এর লেভেল যতই বাড়তে থাকে ততো বেশি এটি ভংকর রূপ ধারণ করতে থাকে। এবং এর ৫০ নং লেভেলে প্লেয়ার কে সুইসাইড করার চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়। আর খুব কম মানুষই আছে যারা এর থেকে বেঁচে ফিরেছে।
.
প্রথম ১০টি চ্যালেঞ্জ কম্পিলিট হওয়ার পর গেমারকে পরবর্তী ১০ লেভেল খেলার জন্য প্রিপেয়ার করানো হয়। যেহুতু টিনএজরা কল্পনা প্রবল হয়ে থাকে সেহেতু এইহ লেভেল গুলোতে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে প্রচুর কল্পনা করানো হয়। আর এই পর্বে চলতে থাকে ছলেবলে কৌশলে তাদের পার্সনাল ইনফরমেশন হাতিয়ে নেওয়ার কাজ। আর একজন প্লেয়ার নিজের অজান্তেই তাদেরকে সব তথ্য দিতে থাকে। এই পর্বে ১৫ লেভেলের পর গেমারকে একটি নীল তিমির একটি ছবি আঁকতে শেখানো হয় এবং পরবর্তী কোন এক লেভেলে ব্লেড দিয়ে হাত কেটে উক্ত ছবিটি আঁকতে বলা হয়। বলা হয় যে, ব্লেড অথবা সুচ দিয়ে তোমার হাতে একটি ব্লু হোয়েলের (নীল তিমির) ছবি আঁক, কিন্তু সাবধান এর ক্ষত যেন বেশি গভীর না হয়। আর এভাবেই শেষ হয় আরও দশটি লেভেল ।
.
প্রথম ২০টি চ্যালেঞ্জ কম্পিলিট হওয়ার পর পরবর্তী ২১-৩০ নং লেভেলে গেমার টিম তাদের কৌশল পাল্টে ফেলে। কারণ ইতিমধ্যেই তারা একজন গেমারের ছোট-খাটো সকল তথ্য ও পার্সনাল ইনফরমেশন নিয়ে নিয়েছে। এর পরই তারা গেমারকে বেশ কিছু কঠিন চ্যালেঞ্জের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই পর্বেরহ চ্যালেঞ্জগুলোর অনেকটা “হিপন্সিস” এর মাধ্যমে ঘটানো হয়। হিপ্নসিস হলো মানুষের মস্তিস্ক নিয়ন্ত্রন করার একটি প্রক্রিয়া। শুরুতেই আমি বলেছি নির্মাতা এবং তার টিম মনোবিজ্ঞানের স্টুডেন্ট। আর এই প্রক্রিয়াকে নিখুঁতভাবে কাজে লাগিয়ে গেমারকে পরবর্তী চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত করা হয়। যেমন, ঠান্ডার রাতে একটা হালকা ড্রেস পরে সারারাত জেগে থাকা এবং সারাদিন না খয়ে থাকা, পরিবারের সাথে ঝগড়া করা এবং বাড়ি থেকে টাকা চুড়ি করা, ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধবের একান্তই কিছু ব্যক্তিগত জিনিশ চুরি করা, ভোররারে কবরস্থানে যাওয়া এবং প্রমান হিসেবে সেগুলোর একটি করে ফটো আপলোড দেওয়া ইত্যাদি। ২৫ লেভেলের পর গেমারকে বিভিন্ন ড্রাগ নিতে অভ্যাস্ত করা হয় এবং খুব সুক্ষভাবে হিপ্নসিসের মাত্রা বৃদ্ধি করে লেভেল ৩০ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
.
৩০ টি চ্যালেঞ্জ সম্পুর্ন হলে ব্লু হোয়েল টিম আরও বেশি কৌশলী হয়ে উঠে এবং তারা পরবর্তী লেভেল গুলো একেবারেই আনলক করতে চাই না। আর এদিকে ৩০ টি লেভেল কম্পিলিট করে একজন গেমারের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, সে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে এর জন্য সে যেকোন কিছু করতে করতে প্রস্তুত থাকে। আর তারা এটাকেই সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে তারা গেমের ৩১ নং চ্যালেঞ্জ আনলক করে দেয় আর তাতে বলা হয় যে, তুমি নগ্ন পোজে বেশকিছু ফটো তুলে আমাদের কাছে আপলোড করো।
গেমার তখন ড্রাগের কারণে হোক অথবা হিপন্সিস জনিত কারনেই হোক সে গেমটার প্রতি এতটাই অ্যাফেক্টেড হয়ে পরে যে সে নিজের নগ্ন ফটো আপলোড দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। আর এ ভাবেই গেমটি তাকে পরবর্তী লেভেল গুলোতে বাধ্য করে অতি ভারিমাত্রার ড্রাগ নিতে, কারও সাথে সেক্স করে তার ফটো আপলোড দিতে আর গেমটির ৪০ নং চ্যালেঞ্জে বলা হয় যে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত পক্ষে ২৫ থেকে ৩০ টা সুচ প্রবেশ করিয়ে তার একটি ফটো আমাদের কাছে সেন্ড করো।
.
এরপর আরো মারাত্মক হয়ে উঠে ব্লু হোয়েল টিম। তারা গেমারকে ড্রাগে আসক্ত করে এবং ব্ল্যাকমেইল শুরু করে। এ পর্যায়ে কোনো গেমার চাইলেও আর গেইম থেকে বের হতে পারে না। বলা হয় এ গেইম আনইন্সটল করলে তাদের নগ্ন ছবি আর পার্সোনাল ইনফরমেশন অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হবে, ড্রাগ সেবনের ছবি পুলিশকে দেওয়া হবে ইত্যাদি। এই লেভেলে তারা গেমারকে দিয়ে গেইম টির লিঙ্ক শেয়ার করায় তার মত কোনো বন্ধু বা ব্যক্তির কাছে। যা তাদের মূল লক্ষ্য। ৫০ তম লেভেলে টিম গেমারকে একটি ড্রাগ সংগ্রহের নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনা অনুযায়ী গেমার ড্রাগটি সংগ্রহ করে ফেলে এবং সেটি নিয়ে একটি উঁচু ভবনের ছাদের একবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে সেটিকে নিজের শরীরে পুশ করে দেয়। পুশ করার একটি সেলফি তুলে সেটি ব্লু হোয়েলে আপলোড করে এবং এর টিম মেম্বাররা এটি নিশ্চিত হয়ে তাকে কংগ্রাচুলেশন্স জানায় । বলে তুমি এই গেমের সকল লেভেল সম্পুর্ন করেছ এবং তোমাকে আমাদের আর দরকার নেই, তাই আজ থেকে তুমি মুক্ত। নিচে তাকিয়ে দেখ তোমার গন্ত্যব্য তোমাকে ডাকছে, সূতরাং,
বেশি দেরি করো না, এক্ষনি ঝাঁপ দাও। আর গেমার তখন ড্রাগ অ্যাফেক্টেড থাকার কারনে সম্পুর্ন হীতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং বুঝতে পারে না যে, তাকে কি করতে হবে। প্রচন্ড ঘু্মের চাপে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, সে চারদিকে ঝাপসা দেখতে শুরু করে। নিজের অজান্তেই সে সত্যি সত্যিই ঝাঁপ দিয়ে বসে এবং নিজের মুক্তির পথ খুজে নেয়। আর ব্লু হোয়েলও খুজতে থাকে তার পরবর্তী শিকারকে।
.
পুরো গেইমে টিমের সাথে গেমারের যোগাযোগের প্রক্রিয়াটি গোপন রাখতে বলা হয়। আর এই গেইমের লিঙ্কটিও বা গোপন। আপনার আমার সাধারণ ব্রাউজার দিয়ে সে লিঙ্কে ঢোকা সম্ভব নয়। এরজন্য দরকার হয় একটি বিশেষ ব্রাউজার এর। যা একজন গেমারের থেকে অন্যজনের কাছে যায়!
এই টিম এতটাই ধূর্ত যে তদন্তকারীরা এখনো তাদের কাছে পোঁছাতে পারছে না। রাশিয়া, আমেরিকা, চীন, ইংল্যান্ড এর মত দেশগুলো ২০১৫ সাল থেকেই আক্রান্ত এ গেইমে। সাড়া বিশ্বে মৃতদের ৯০% এর বয়স ১২-১৮! যাদের অধিকাংশ ছিল, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, মানসিকভাবে বিষণ্ণ, প্রেমে ব্যার্থ বা অবসাদগ্রস্ত। আমেরিকা, রাশিয়া বা চীনের মত দেশগুলো স্কুলে স্কুলে Anti Blue Whale ক্যাম্পেইন চালু করেছে। টিনএজারদের ইন্টারনেট ব্যবহারে আনছে নিয়ন্ত্রণ। গুগোল ব্লু হোয়েলের ব্যাপারে যেকোনো সার্চে নজর রাখছে। তারপরও থামছে না এই মরণ থাবা।
.
সম্প্রতি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দুজন এবং কয়েকদিন আগে আমাদের দেশে ঢাকায় ১৩ বছরের এক তরুণী প্রাণ হারিয়েছে এই গেইমে। মৃতদের সবার শরীরেই পাওয়া যায় নীল তিমির চিহ্ন! আমার এই আর্টিকেলটি লিখার উদ্দেশ্য আপনাদের কৌতুহল জাগানো নয়। আপনাদের সতর্ক করা। আপনারা বুঝতেই পারছেন কি করতে হবে।
.
প্রশ্ন হলো, কেন আমরা ১২/১৩ বছরের বাচ্চার হাতে এন্ড্রোয়েড তুলে দিচ্ছি? ইন্টারনেটের কোন যায়গাটাতে বিচরণ করছে আমাদের টিনএজাররা? তাদের কিসের এতো বিষণ্ণতা? আমরা কি তাদের পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছি? জানতে চাইছি কি তাদের সমস্যাগুলোর কথা? কেন তারা তাদের সমস্যাগুলো আমাদের সাথে শেয়ার না করে শেয়ার করছে ব্লু হোয়েলের সাথে!
এটি মরণ ফাঁদ। এর থাবা ভয়াল। একবার ঢুকে গেলে খুব কম লোকই ফিরে আসতে পেরেছে এই গেইম থেকে। আর এই গেইম আপনার কাছে আসবে আপনারই কাছের কারো থেকে। এই গেইমের লিঙ্ক পেলে ফাদে পা না দিয়ে তাকেই বাঁচানোর চেষ্টা করুন। কারণটা নিজেই পড়েছেন। বিষণ্ণতা কাটানোর অনেক উপায় আছে। ব্লু হোয়েল কোনো সমাধান নয়। এটি একটি নেশা, এটি মৃত্যু...
পোষ্টটি শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
Copyright © 2018 Info Bank