বার্সার ইতিহাস বদলে দেয়া এক নায়ক রোনালদিনহো











মেসিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, “বার্সার সর্বকালের সেরা কে?” তাঁর জবাব ছিলো, “আমি নিজে বার্সার সর্বকালের সেরা নই, বার্সার সর্বকালের সেরা রোনালদিনহো। তিনি ক্লাবের ইতিহাসের পথই বদলে দিয়েছিলেন।” সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সফল ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা। কিন্তু রোনালদিনহো বার্সায় আসার আগে দলের গতিপথ এরকম ছিলো না। কেমন ছিলো বার্সার সেই সময়? আর কিভাবেই বা একজন তরুণ, অনভিজ্ঞ প্লেয়ার সেই সময়টাকেই বদলে দিলো? আজকের পুরো লেখা জুড়ে চলুন সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরই খুঁজে ফেরা যাক।
রোনালদিনহোকে নিয়ে মেসির উক্তি Source: messi10stats
১৯৯০-১৯৯৯ সময়টাকে বার্সার জন্য স্বর্ণযুগ বলা যায়। ক্রুয়েফের ড্রিম টিম টানা লীগ জিতেছিল ৪টি। তারপর ১৯৯৭-এ ভ্যান গাল এসেও টানা দুইটি লীগ জেতেন। ১৯৯৯ এ ভ্যান গালের সেই লীগ জেতার পর বার্সার আচমকাই স্থবিরতা চলে আসে। একের পর এক ফ্লপ সাইনিং, ঋণের বোঝা- সব এসে জুটতে থাকে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হয়ে আসে শিরোপাশূন্যতা। নয় বছরে ছয়টি লীগ জেতা দল ১৯৯৯ এর পরে দুই সিজন কোনোক্রমে চতুর্থ আর ২০০২-০৩ সিজনে হলো ষষ্ঠ! কোনো শিরোপা নেই। আবার ওদিকে রিয়াল মাদ্রিদ ঘরোয়া আর ইউরোপ দুই জায়গায়ই প্রাধান্য বিস্তার শুরু করেছে। ঠিক সেই সময়টায় বার্সা কোনো আদর্শ জায়গা ছিলো না নতুন প্রতিভাবান প্লেয়ারদের জন্য।
রোনালদিনহোকে নিয়ে ভালদেস Source: FCBarca Lover
নির্বাচন ঘোষণা হলো বার্সেলোনা ক্লাবে, ৪০ বছরের আইনজীবী লাপোরতা একজন প্রার্থী। তার প্যানেল ঘোষণা দিল জিতে গেলে ডেভিড বেকহ্যামকে ক্লাবে নিয়ে আসবে। তখন বেকহ্যাম নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্লেয়ার, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আইকন। সবচেয়ে বড় কথা বার্সার সেই অবস্থা থেকে উঠে আসার জন্য এমনই একজনের দরকার ছিল। লাপোরতা জিতে গেলেন, কিন্তু তিনদিনের মাথায় সবচেয়ে বড় দুসংবাদ পেলেন লাপোরতা। বেকহ্যাম বার্সায় নয়, যোগ দেবেন রিয়াল মাদ্রিদে। আপাদমস্তক বিজনেসম্যান রিয়াল প্রেসিডেন্ট পেরেজ নীরবে সবচেয়ে বেশী বিপনন-অনূকুল প্লেয়ার বেকহ্যামকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে নিয়ে এলেন রিয়ালে।
বার্সার নতুন বোর্ডের হানিমুন পিরিয়ড খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেলো। তাদের তাড়াতাড়ি পদক্ষেপ নিতে হবে। এদিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বেকহ্যামকে রিপ্লেস করার জন্য রোনালদিনহোকে নিয়ে আসতে চায়, প্রক্রিয়া প্রায় শেষের দিকে। বোর্ড সহ-সভাপতি স্যান্দ্রো রোজেলের ব্রাজিলের ফুটবল এজেন্টদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। সেসব লিঙ্ক ধরেই তিনি রোনালদিনহোকে রাজি করাতে সক্ষম হন বার্সায় আসার ব্যাপারে। ১৯৯৯, ২০০১ কোপা আমেরিকায় পারফর্মেন্স আর পিএসজিতে চোখ ধাঁধানো খেলা রোনালদিনহোকে পুরো বিশ্বের কাছে ততদিনে তুলে ধরেছে। ও হ্যাঁ, আসলটাই তো বলা হয়নি, রিভালদো-রোনালদোর সাথে জুটি করে ২০০২ বিশ্বকাপে তাঁর পারফর্মেন্স ততদিনে ফুটবল বিশ্বে বহুল চর্চিত। রোজেল তাকে রাজি করানোর সময় বলেছিলেন যে, তাকে কেন্দ্র করেই দল গঠন করবে বার্সা। ২০০৩ সালে অসম্ভব প্রতিভাবান কিন্তু অনভিজ্ঞ এক তরুণ যোগ দিলো বার্সেলোনায়। তখন কি কেউ ভেবেছিলো বেকহ্যামকে না পাওয়াটা কত বড় শাপেবর হতে যাচ্ছে বার্সার জন্য?
বার্সায় মানিয়ে নিতে একদমই সময় নিলেন না রোনালদিনহো। ক্যাম্প ন্যুতে নিজের অভিষেক ম্যাচে মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে দুই সেভিয়া প্লেয়ারকে নাচিয়ে ডি বক্সের বাইরে থেকে এক রকেট শ্যুটে যখন গোল করে তাঁর আগমন বার্তা দিয়ে দেন, তখনই আসলে বার্সায় শুরু হয় রোনালদিনহো শো।
তাঁর হাসির মতোই মোহনীয় ছিল তাঁর স্কিল। ক্যাম্প ন্যু অনেকদিন পর উজ্জীবিত একটা দল দেখতে পেল এক ২৩ বছরের প্লেয়ারের কল্যাণে। কিন্তু সিজন শুরুর কিছুদিন পর ইনজুরিতে পড়েন রোনালদিনহো। দল আবার ধুঁকতে শুরু করে। যখন ইনজুরি থেকে ফিরে আসেন, তখন বার্সা টেবিলের ১২ নম্বর স্থানে! লীগের দ্বিতীয়ার্ধে ১২ গোল করে দলকে ১২তম স্থান থেকে টেনে তোলেন ২য় স্থানে। ১৫ গোল আর ১২ এসিস্ট নিয়ে শেষ করেন প্রথম সিজন। ততদিনে কোচ রাইকার্ডের অধীনে বার্সা গুছিয়ে উঠতে শুরু করে। রোনালদিনহোর সাথে দলের বোঝাপড়া গড়ে উঠে সতীর্থদের।
শুধু গোল আর এসিস্ট দিয়ে বোঝানো যাবে না তাঁর আসল প্রভাব। ধরা যাক, আপনি তিন প্লেয়ারকে কাটিয়ে থ্রু বল বাড়ালেন একজনকে। সে মাইনাস করলো আর অপর আরেকজন কেবল পা লাগিয়েই গোল করে দিলো। ফুটবলের কোনো পরিসংখ্যানেই লেখা থাকবে না যে গোলটির আসল রুপকার আপনি। রোনালদিনহো এসব পরিসংখ্যানের বাইরেও ছিলেন নেপথ্যের আসল কারিগর! তাঁর সতীর্থ ডেকো বলেছিলেন, “অনেক সময় আমাদের কোনো ধারণাও ছিলনা যে, প্রতিপক্ষ ডিফেন্স কিভাবে ভাঙব। রোনালদিনহো ঠিকই উপায় বের করে ফেলতেন। এটা ট্যাকটিক্স বা গেমপ্ল্যানের অংশ না, এটা তাঁর সহজাত খেলা।
আপনি বলতে পারেন, “১১ জনের একটা খেলায় কিভাবে একজন দল পাল্টে দেয়?” উত্তর হলো- “ঠিক যেমন কোনো এক নেতার ডাকে সহস্র জনগণ যুদ্ধে নামে, তেমনই। নেতা একা যুদ্ধ করেন না। কিন্তু একজনকে আগে উঠে দাঁড়াতে হয়, যেমন এক থলে বারুদের জন্য কেবল একটা স্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট। হতাশাগ্রস্ত এক বার্সায় প্রাণ এনে দেন রোনালদিনহো।
চেলসির সাথে রোনালদিনহো; Source:101 Great Goals
পরের সিজনে বার্সাকে আর ধুঁকতে হলো না। ডেকো, ইতোকে নিয়ে রোনালদিনহো গড়ে তোলেন অসাধারণ এক জুটি। সেবার বার্সা লীগ জিতে নেয়। গোল আর এসিস্ট মিলিয়ে ৪০ এর বেশী সংখ্যক গোলে অবদান রেখে ছয় বছর পর দলকে লীগ জেতান রোনালদিনহো। ততদিনে বিশ্বের সেরা প্লেয়ার হিসেবে তাকে নিয়ে খুব বেশী তর্ক আর খাটে না। পরের সিজনে যেন আরো শাণিত হন। ক্যারিয়ার সেরা ২৬ গোলের এক সিজন পার করেন তিনি। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে চেলসিকে শেষ ষোলোতে হারায় বার্সা, চেলসি ডিফেন্ডারদের নাচিয়ে নির্ণায়ক গোলটি করেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে বেনফিকাকে হারানোর দু’গোলের একটি তাঁর পাস থেকে। সেমিফাইনালে মিলানকে বিদায় করা একমাত্র গোলটিও তাঁরই বানিয়ে দেয়া। ফাইনালে আর্সেনালকে হারিয়ে বার্সা জিতে নেয় তাদের ইতিহাসের ২য় চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ট্রফি। এর সপ্তাহ দুয়েক আগে তারা ঘরে তোলে লীগ ট্রফি। চার বছর শিরোপাহীন থাকা দলটি তিনি আসার পর তিন বছরেই জিতে নেয় দুটি লীগ আর একটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ শিরোপা। বার্সার মূল দলের সাফল্যের রেশ এসে লাগে তাদের যুব দলেও। মেসির ভাষায়, “আমরা একটা অন্ধকারের মধ্যে ছিলাম। আমাদের নতুন বিশ্বাসটা তাঁরই দেয়া।” এই সময়ে তিনি জিতে নেন একটি ব্যালন ডি অর আর দুটি ফিফা বর্ষসেরা সহ অসংখ্য পুরষ্কার।
চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ট্রফি হাতে রোনালদিনহো; Source: Soccer Laduma
২০০৫-০৬ সালে বার্সা যখন মাদ্রিদকে বারনাব্যুতে ৩-০ গোলে হারায়, সেই ম্যাচে ২ গোল করেন তিনি। সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হলো পুরো ম্যাচ তিনি এত অসাধারণ খেলেছিলেন যে, বারনাব্যু তাকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিলো তাঁর দ্বিতীয় গোলের পর। ম্যারাডোনা ছাড়া জ্ঞাত ইতিহাসে বার্সার কোনো প্লেয়ার রিয়ালের মাঠে এমন অভিবাদন পায়নি। প্রবল বিরোধী প্রতিপক্ষই যখন এমন অভিবাদন দেয়, তাঁর খেলা নিয়ে সবিশেষ বলার আর কী-ই বা থাকতে পারে!
যুব একাডেমিতে খুব ভালো খেলছে এক ছেলে, এমনটা শুনে তাঁর খেলা দেখতে যান রোনালদিনহো। দেখার পর সদ্য বর্ষসেরা খেতাব জেতা রোনালদিনহো নিজেই বলেন, “আমি খোদ বার্সেলোনাতেই সেরা নই, বার্সেলোনার সেরা প্লেয়ার এখনো একাডেমীতে খেলে।” তিনি আর কেউ নন, লিওনেল মেসি। মেসির ভাষায়, “১৬ বছর বয়সে বার্সা ড্রেসিংরুমে আসাটা সহজ কোনো ব্যাপার নয়। তবে রোনালদিনহো আমার জন্য পরিবেশটা সহজ করে দিয়েছিলেন।” মেসিকে তরুণ অবস্থায় খাপ খাওয়াতে তাঁর বড় অবদান ছিল, এমনকি মেসির প্রথম বার্সার হয়ে গোলটা তাঁরই বানিয়ে দেয়া। সেই পাসটা কেবল একটা পাস ছিল না, ছিল একটা ব্যাটন, যে ব্যাটনটা হাতে এখনো মেসিরা এগিয়ে যাচ্ছেন।
মেসির সাথে রোনালদিনহো; Source: GiveMeSport
২০০৩ সালে রোনালদিনহো যখন বার্সেলোনাতে আসেন, বার্সা তখন দিকভ্রষ্ট, পতনরত এক দল। চার বছর পর তিনি যখন ক্লাব ছাড়েন, তখন বার্সা ইউরোপের এক পরাশক্তি, অনেক প্লেয়ারের স্বপ্নের দল। মাঝের সময়টা ছিলো রোনালদিনহোময়। এ সময়টাই বার্সাকে তাঁর সাফল্যের পথে ফিরিয়ে দেয়। এরপর বার্সার ট্রফি কেবিনেট কেবল বৃদ্ধিই হয়েছে। বেকহ্যামকে না পেয়ে দ্বিতীয় অপশন হিসেবেই তাকে নিয়ে আসে বার্সা। বেকহ্যাম রিয়ালে বিশেষ কোনো অবদান রাখতে পারেন নি, অন্তত রোনালদিনহোর মতো না। সেই জায়গায় রোনালদিনহো ছিলেন একটি যুগের অবসান করে নতুন যুগের সূচনাকারী একজন খেলোয়াড়। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার কথায়, “রোনালদিনহো কারো নাম নয়, এটা হলো ম্যাজিক আর  শিল্প। সে বার্সাকে অনেক কিছু দিয়েছে,  দিয়েছে সাফল্য আর বিশ্বাস।
Copyright © 2018 Info Bank